পুরোনো ও নষ্ট মোবাইল ফোন সেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, অকেজো ও অব্যবহৃত ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি ফেলে দেওয়ার যোগ্য হলেও তা মোটেও ফেলনা নয়। এসব ই-বর্জ্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তামা, দস্তা, রুপা, স্বর্ণ, প্লাটিনাম বা প্যালাডিয়ামের মতো মূল্যবান ধাতু। এমনকি এসব ই-বর্জ্য থেকে পাওয়া প্লাস্টিকও বেশ দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজার সূত্র বলছে, দেশে মাসে শতকোটি টাকার ই-বর্জ্য থেকে পাওয়া উপাদানগুলো বেচাকেনা হয়, বছরে যার পরিমাণ ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি।
ই-বর্জ্য সংগ্রহ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও মোবাইল ফোন বা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারকারীদের মাঝে সাড়া কম। কোনও কিছু নষ্ট হয়ে গেলে বা মেরামত উপযোগী না থাকলে, তা কোথায় ফেলতে হবে সেটা বেশিরভাগেরই জানা নেই। ফলে এসবের ঠাঁই হয় ঘরের কোণে, খাটের নিচে, ফলস ছাদে বা চিলেকোঠায়। এভাবে জমতে জমতে তার বিস্তার বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যক্তিগত ব্যবহারকারীরা এখনও সচেতন নন। এতে ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের, এমনকি বাসার ছোট্ট শিশুটিরও। কারণ, শিশুরা না জেনেই এসব মুখে তুলে নেয়। ব্যবহারকারীরা সচেতন হলে ই-বর্জ্যের স্তূপ হবে না। আর এ কারণেই যারা এসবের রিসাইক্লিংয়ের সঙ্গে জড়িত তারা বলছেন—ব্যক্তি পর্যায় থেকে এখনও ই-বর্জ্য সংগ্রহে সাড়া কম। যা হচ্ছে তার বেশিরভাগই করপোরেট পর্যায় থেকে। এছাড়া অন্যান্য আরও যেভাবে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে তার পরিমাণ খুবই কম।
ই-বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ বা নষ্ট হয়ে যাওয়া মোবাইলফোন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনার, বৈদ্যুতিক বাতি, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ইত্যাদি। এসবে রয়েছে সিসা, পারদ, লিড অক্সাইড, ক্যাডমিয়াম জাতীয় ধাতব ও রাসায়নিক উপাদান।
বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (বিআইজেএফ) গত জুন মাসে ‘ই-বর্জ্যের কার্বন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ: কারণ ও উত্তরণের পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। সেই আলোচনায় বক্তারা জানান, প্রতিবছর দেশে জমছে ৩০ লাখ মেট্রিক টন ই-বর্জ্য, যার মধ্যে শুধু স্মার্ট ডিভাইসেই সৃষ্টি হচ্ছে সাড়ে ১০ টন ই-বর্জ্য। ২ লাখ ৯৬ হাজার ৩০২ ইউনিট নষ্ট টেলিভিশন থেকে সৃষ্টি হচ্ছে ১ দশমিক ৭ লাখ টনের মতো ই-বর্জ্য। জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে আসছে ২৫ লাখ টনের বেশি। আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এই বর্জ্য বাড়ছে ৩০ শতাংশ হারে।
ফেলনা বর্জ্য থেকে আয় কোটি টাকা
জানতে চাইলে আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়াস্ট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান শাহীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে প্রতি বছর যে পরিমাণ মোবাইল ফোন নষ্ট হয়, তার ২০ ভাগও আমরা রি-সাইক্লিংয়ের জন্য পাই না। ব্যবহারকারীরা হয় তা মেরামতের পর ব্যবহার করেন, নয়তো ঘরে ফেলে রাখেন। ফলে যে পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হয়, তার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠানগুলো পায় না।’ তিনি জানান, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটি মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস প্রথমেই আলাদা করে ফেলা হয়। তারপর তা থেকে প্লাস্টিক, মেটাল (ধাতব পদার্থ), আইসি আলাদা করে ফেলা হয়। প্লাস্টিক পৃথক করার পর চিপস তৈরি করে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়। আর মেটাল পৃথক করে তামা, দস্তা, রুপা পাওয়া যায়। স্বর্ণ, প্লাটিনাম, প্যালাডিয়াম, রোডিয়ামের মতো মূল্যবান ধাতুও পাওয়া যায়। মূল্যবান ধাতু নির্ভর করে গ্রেডভিত্তিক সার্কিট বোর্ডের ওপর। তিনি বলেন, ‘এসব কারণে এই বাজারটা মোটেও ফেলনা নয়। বরং ফেলনা কুড়িয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।’
সাইদুর রহমান শাহীন জানান, ই-বর্জ্যের বাজারটা শত কোটি টাকার (মাসিক)। নারায়ণগঞ্জে তার একটি প্ল্যান্ট আছে। শিগগিরই তিনি আরেকটি প্ল্যান্ট তৈরি করবেন।
বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমপিআইএ)-এর যুগ্ম সম্পাদক মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন জানান, প্রতি বছর দেশে গড়ে সাড়ে ৩ কোটি মোবাইল ফোন বিক্রি হয়। (যদিও গত অর্থবছরে দেশে আড়াই কোটির মতো মোবাইল সেট বিক্রি হয়েছে)। একটি মোবাইল ফোনের লাইফ সাইকেল ৩-৪ বছর। ফলে দেশে প্রতি বছর ৩ কোটির মতো মোবাইল সেট ই-বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে।
অভিযোগ আছে, মোবাইল রিসাইক্লিংয়ের সময় কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান আইসি (ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট) পৃথক করে রেখে তা চীনে পাঠায়। সেখানে সেগুলো মেরামত করা হয় ক্ষেত্রবিশেষে। চীন থেকে যেসব নন ব্র্যান্ডের মোবাইল সেট দেশে আসে, সেসবে পুরোনো এই আইসি ব্যবহার করা হয়। এসব মোবাইল ফোন বেশি টেকসই হয় না। তবে বিষয়টি কেউই স্বীকার করেনি। যদিও এই বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে।
ই-বর্জ্য রি-সাইক্লিং প্রতিষ্ঠান
আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়াস্ট কোম্পানি লিমিটেড, গ্রিন বাংলা করপোরেশন, জেআর এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স ইউসুফ এন্টারপ্রাইজ, বিজ লজিস্টিকস অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং লিমিটেড, এনএইচ এন্টারপ্রাইজ, জামান এন্টারপ্রাইজ, টেকনো ফেয়ার, এমএম এন্টারপ্রাইজ, প্রো রি-সাইক্লিং লিমিটেড, মোহাম্মদ সৈয়দ ট্রেডিং ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান সর্বশেষ গত মে মাসে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা (বিটিআরসি) থেকে তিন বছরের জন্য অনুমোদন নিয়ে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা মোবাইল ফোন, কম্পিউটারের মাদার বোর্ড, টেলিভিশনের সার্কিট বোর্ড, ব্যাটারি, রেফ্রিজারেটরের যন্ত্রাংশ ইত্যাদি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং করছে।