সর্দি জ্বর আর শুকনা কাশি থেকে মাত্র সেরে ওঠা শিশু এক মাসের ব্যবধানে আবারও কাশিতে আক্রান্ত হয়। একদিন না যেতেই কাশতে কাশতে ছয় বছরের শিশুটি বলে— আজকে নেবুলাইজ করতে হবে। সে জানে, এটা শুধু বাসাতে মা-ই করতে পারে। আর তাতে তার আরাম হয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে— তার মা কি আদৌ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নেবুলাইজ করান, নাকি সন্তানের কাশি হলেই আরাম দেওয়ার জন্য নেবুলাইজ করে দেন। এই মমতা দীর্ঘ মেয়াদে সন্তানের ক্ষতি করছে নাতো!
আগে শীত এলেই শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ নিয়ে রোগীদের ভোগান্তি দেখা যেতো। হাঁপানি, ব্রংকাইটিসসহ নানা রোগের তীব্রতা শীত মৌসুমে বেশি হতো। শ্বাসকষ্টে ভোগা শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষকে এসময় অন্য ওষুধের পাশাপাশি অনেকেই ইনহেলার ও নেবুলাইজার ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হতো। শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের ক্ষেত্রে ইনহেলার ব্যবহার করা অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক। তুলনামূলক সহজ বিকল্প হলো নেবুলাইজার। কিন্তু এখন বছরে তিন-চার বার ঠান্ডা কাশির প্রকোপ দেখা দেওয়ায় ভোগান্তি বেড়েছে এবং স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়ম ও প্রাথমিক চিকিৎিসার বাইরে দ্রুত সুস্থ হওয়ার জন্য নেবুলাইজারের ব্যক্তিগত ব্যবহারও বেড়েছে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণেই হুটহাট নেবুলাইজার ব্যবহার ঠিক না। শিশু যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেখানে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ‘পুরোনো পদ্ধতি’ ভুলে গেলে চলবে না। সেই চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে নেবুলাইজ করা যেতে পারে।
তবে নেবুলাইজ মেশিন বিক্রিবাট্টার রমরমা অবস্থা। রাজধানীর বড় বড় ফার্মেসিগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা সময়ের পর থেকে প্রায় তিনগুণ বেড়েছে নেবুলাইজার মেশিন কেনার হার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা রেফার করেন। দেড় হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা দামের নেবুলাইজার মেশিন পাওয়া যায়। অনলাইনেও এর বিক্রি অনেক বেড়েছে।
উল্লেখ্য, শ্বাসনালি ও ফুসফুসে অক্সিজেন ও ওষুধ পৌঁছে দিতেই নেবুলাইজার মেশিনটি ব্যবহার করা হয়। ফুসফুসে সংক্রমণ হলে বা ওষুধ দিতে হলে নেবুলাইজারের মাধ্যমেই তা দেওয়া হয়ে থাকে। এতে কাজ হয় তাড়াতাড়ি। এর মাধ্যমে মেডিকেটেড ভেপার নাকের মধ্য দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে। ফলে কোনও শিশু বা পূর্ণবয়স্ক মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ হলে দ্রুত ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করে এই নেবুলাইজার নামক যন্ত্রটি।
ইউরোপীয় রেসপিরেটরি সোসাইটি (ই. আর. এস) স্বীকার করে যে, হাঁপানি, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সি. ও. পি. ডি) এবং অন্যান্য বুকের রোগের ব্যবস্থাপনার জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অনেক নির্দেশিকা আছে। এই নির্দেশিকাগুলোর মধ্যে কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নেবুলাইজার ব্যবহার করে শ্বাসনালী বা ফুসফুসে ওষুধ দেওয়ার পরামর্শ আছে। যদিও গুরুতর বুকের রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীকে হাসপাতালে এবং তাদের নিজের বাড়িতে নেবুলাইজড চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে সেটা যে কার্যকর, তা অবশ্যই যথাযথ পরীক্ষার পরে হওয়া উচিত।
নয়াদিল্লির সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ আঙ্কিত পারেখ খুবই সতর্কতার সঙ্গে নেবুলাইজার ব্যবহারের বিষয়ে সতর্ক করে একাধিক ব্লগ লিখেছেন। তিনি তার ব্লগে লিখেছেন, বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করেন যে, নেবুলাইজেশন কাশি, শ্বাসকষ্ট, এবং শ্বাসকষ্টের মতো যেকোনও শ্বাসকষ্টের লক্ষণ থেকে মুক্তি দিতে পারে। সব কাশি এবং সর্দি-কাশির জন্য নেবুলাইজেশনের প্রয়োজন হয় না। আপনার সন্তানের কাশি বা অসুস্থতার কারণ প্রথমে শনাক্ত না করে আপনার নেবুলাইজার ব্যবহার করা উচিত নয়। নেবুলাইজার শুধুমাত্র ডাক্তারের পরামর্শে ব্যবহার করা উচিত এবং পরামর্শ না দেওয়া পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়।
আঙ্কিত পারেখ আরও উল্লেখ করেন, নিবুলাইজেশন স্বল্পমেয়াদি শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির লক্ষণগুলোর জন্য সহায়ক হতে পারে। বারবার শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির পর্বের শিশুদের জন্য, ইনহেলার ব্যবহার করা আরও উপযুক্ত। দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহারের জন্য নেবুলাইজারের তুলনায় ইনহেলারগুলোর অনেক সুবিধা রয়েছে।
এমনকি নেবুলাইজারের যে যত্ন নিতে হয়— সে বিষয়েও বেশিরভাগ মানুষ সতর্ক নন। সত্তরোর্ধ এক রোগীকে একদিন পরপর নেবুলাইজ করতে বলেছেন চিকিৎসক। তার বাসায় যে নার্স নেবুলাইজ করান, তিনি প্রতি দিন সেটি পরিষ্কার না করে রেখে দেন। পরের দিন ওই অবশিষ্ট লেগে থাকা ওষুধেই নতুন ওষুধ দিয়ে ব্যবহার করা হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, নেবুলাইজারগুলো পরিষ্কার না রাখলে ভালোর চেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে বেশি। প্রতিটি ব্যবহারের পরে, গরম পানি দিয়ে নেবুলাইজার কাপটি ধুয়ে ফেলতে হবে এবং বাতাসে শুকিয়ে নিতে হবে। নেবুলাইজার কাপ, মাস্ক এবং মাউথপিস হালকা ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেলা যেতে পারে। কিন্তু সপ্তাহে দুবার নেবুলাইজার কাপটি ১৫-২০ মিনিটের জন্য ভিনেগার সলিউশনে দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা দরকার। তা না হলে এখান থেকেও নানা সংক্রমণ ঘটার শঙ্কা থাকে।
যদি কোনও ওষুধ প্রয়োগের প্রয়োজন না হয়, তারপরও রোগী সেটি সেবন করে, তবে তার অতিপ্রয়োগ ও অতিপ্রয়োগে নিশ্চিত ক্ষতি হবে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চোধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এতে করে রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ ছাড়া না বুঝে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া, ভুল মাত্রায় বা ভুল ওষুধ সেবন করলেও জটিলতা দেখা দিতে পারে।’ কোনও ওষুধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মানুষের শরীর প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। এজন্য খোলা আকাশে, আলোতে বাতাসে ঘুরবে, খলি পায়ে ঘাসে হাঁটবে। নেবুলাইজার দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা পদ্ধতি নয়।’